অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ :
১.
১৯৭১। ১০ এপ্রিল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মুজিবনগর সরকার গঠন করেন। তারা দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। তাদের অবহেলা করে বা বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লিখিত হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, জনপ্রতিনিধিরা যদি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যথার্থ ভূমিকা পালন না করতেন তাহলে জেনারেল টিক্কা খান ৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সামরিক আইনে বিচার করে দণ্ডাদেশ দেওয়ার কথা কেন ঘোষণা করেছিলেন? সেক্ষেত্রে তুলনা হিসেবে নয়, ইতিহাসের সত্যকে তুলে ধরার জন্য এ প্রশ্ন উঠতেই পারে-একমাত্র মুক্তিবাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল ওসমানী ব্যতীত অন্য কোনো সামরিক অধিনায়কের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল কি না? সাধারণ নথিপত্রে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সকল কৃতিত্বই তারা করায়ত্ত করে বসে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধে জনগণ বা তার প্রতিনিধিদের যথার্থ মূল্যায়ন হয়েছে কি? নাকি তাদের অবহেলার অন্ধকারে ফেলে রাখা হয়েছে!
২.
সত্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জাতীয় অস্তিত্বের ভয়াবহ ক্রান্তিলগ্নে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার’ অমূল্য দলিল অনুমোদনের ঐতিহাসিক দায় গ্রহণ করেছিলেন। গঠিত হয়েছিল গণপরিষদ ও গৃহীত হয়েছিল স্বাধীনতার সনদ। অনুমোদন করেছিলেন রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং মুজিবনগর সরকার। আবার তারাই ছুটে গেছেন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিবেশী ভারতীয় সীমান্তের কয়েক হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্রাম থেকে আসা যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে উত্সাহিত ও সংগঠিত করতে।
মূলত সেদিন কয়েকশ’ ক্যাম্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রায় সাড়ে তিনশ’ গণপরিষদ সদস্য। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আকাঙ্ক্ষায় ছুটে আসা হাজারো যুবক পেয়েছে আশ্রয়, খাদ্য, ন্যূনতম চিকিত্সা, সর্বোপরি শত্রু হননের জন্য গেরিলা প্রশিক্ষণ। সীমান্ত জুড়ে এই ক্যাম্পগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিভূমি। তারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। প্রায় সকলেই আজ অবহেলিত, উপেক্ষিত ও মর্যাদাহীন। যাঁরা নিয়মিত বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তাদের ভাগ্যে টিকার খেতাব বরিত ছিল। গ্রাম-গঞ্জে, নগর-প্রান্তরে যারা যুদ্ধ করেছেন; এসব দুঃসাহসিক অকুতোভয় গ্রামীণ যোদ্ধার গৌরবময় যুদ্ধকীর্তি কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাত বিধায় এদের ভাগ্যে জোটেনি রাষ্ট্রীয় সম্মানের বরমাল্য।
৩.
লড়াইয়ের মাঠে প্রত্যক্ষভাবে সাংগঠনিক দায়িত্ব কর্তব্য পালনের জন্য যে শতাধিক জনপ্রতিনিধির পাকিস্তান সামরিক ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল, যাঁদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, আত্ম-পরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল সে কষ্টকর অথচ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কোনোদিনও রাষ্ট্র বা সরকার জানতে চায়নি। গবেষণা হয়নি কীভাবে গ্রামে-গঞ্জে, প্রান্তরে জনযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। রাতের আঁধারে অথবা ঘন বৃষ্টির অস্বচ্ছ অন্তরালে শত্রু হননের দারুণ প্রত্যয়ে যাঁরা নিজের জীবনকে করেছেন উত্সর্গ, তাদের পেছনে জনগণের প্রতিনিধিদের প্রতিনিয়ত বেদনাবিধুর মুহূর্তগুলো কীভাবে গেরিলাদের আত্মজ-অভিভাবকত্বে রক্তাক্ত যুদ্ধস্মৃতি তাদেরকে একাত্ম করেছিল, এক দেহ ও সত্তায় রূপান্তরিত হয়েছিল, সে ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণই থেকে যাবে যদি এই ভিত্তিভূমির অসম সময়ের দুঃসাহসিক কীর্তিময় ভূমিকা জাতীয় মর্যাদার অভিধায় অভিষিক্ত না হয়।
৪.
১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যে সকল সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য নানা ধরনের অপবাদ দেওয়া হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধে তারা যথার্থভাবে অংশগ্রহণ করেননি। বিভিন্নভাবে রণাঙ্গন থেকে দূরে থেকে তারা বিলাসী জীবনযাপন করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ভিন্নতর। সিংহভাগ এমএনএ ও এমপিএগণ অর্থাত্ গণপরিষদ সদস্যবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন সামান্যতম গবেষণায় তা বেরিয়ে আসবে। অচেনা ও অজানা জায়গায় নিদ্রাহীন রাত যাপনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দীর্ঘ ৯ মাস তাদের অধিকাংশ দারা-পুত্র-পরিবার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। শুধু পরিবার কেন, নিজের সুখ-সুবিধার দিকেও তাকানোর অবসর পাননি। সরকার গঠন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার সনদ অনুমোদন ও মুজিবনগরের সরকার গঠনে অনেকে অংশগ্রহণ না করতে পারলেও সবারই দৃপ্ত শপথ ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করা। একইসঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি। রণাঙ্গনে দৃশ্যমান ছিলেন বঙ্গবন্ধু রক্ত-হূদয়ের স্লোগানে মুক্তির পতাকা হয়ে।
৫.
সেদিন যদি গণপরিষদের এসব সম্মানিত সদস্য ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করতেন তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তা হতো এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশা কাণ্ড। স্বাধীনতার সংগঠকদের দীর্ঘ ৪৫ বছর উপেক্ষা করা হয়েছে। যেমন উপেক্ষা করা হয়েছে তাদের আশ্রয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধাদের। এদের যথাযথ সম্মান আজও দেওয়া হয়নি। যদিও ৭৫-পরবর্তী সামরিক ও স্বৈরশাসকরা তাদের ব্যবহার করেছে। কিন্তু সম্মান দেয়নি। মর্যাদা দেয়নি। স্বীকৃতি দেয়নি। এমন মূল্যায়নের বাতাবরণ খুলেছেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। তাকে ধন্যবাদ।
৬.
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তা লে. জেনারেল টিক্কা খান ঢাকা, বাকেরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের পাঁচ জনপ্রতিনিধিকে একাত্তরের ২৬ এপ্রিল সকাল ৮টায় ঢাকাস্থ দ্বিতীয় রাজধানীতে এক নম্বর সেক্টরের সামরিক আইনের সাব-অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কাছে হাজির হওয়ার জন্য আদেশ দেন। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামরিক আইনবিধি ও সামরিক আদেশ অনুযায়ী আনীত কতিপয় অভিযোগের জবাবদানের জন্য তাদের হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তারা হাজির হতে ব্যর্থ হলে এমএলআর-৪০ অনুযায়ী তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার করা হবে বলে সামরিক ফরমানে জানানো হয়।
৭.
এসব ত্যাগী মানুষকে নতুন প্রজন্ম যেন নগণ্য মনে না করেন। ইতিহাসে তাদের অমর কীর্তি অক্ষয় এবং যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণার উত্স হয়ে থাকবে। তাদের মহান ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আদর্শ যেন চিরঞ্জীব হয়ে থাকে, তাদের নাম যেন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকে, সেই দায়বদ্ধতা থেকেই এই মহান ব্যক্তিদের নাম লিপিবদ্ধ করতে বিবেক আমাকে তাড়া করেছে। দেশে দেশে যারা এভাবে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদান করেছেন, ইতিহাসে তাদের নাম এবং ফলক চিরকাল দৃশ্যমান হয়ে থাকে। রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা করেছে। তাদের নাম-ঠিকানা উল্লেখ, তাদের ত্যাগ, আদর্শের প্রতি আনুগত্য সোনার বাংলা গড়ার দৃষ্টান্ত সৃষ্টির উপাদান হিসেবে কাজ করবে বলে আমি মনে করি। কোনোদিন কোনো কালে যদি কোনো গবেষক কিংবা ইতিহাসবিদ এসব জনপ্রতিনিধির মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করতে চান সে লক্ষ্যে নামগুলো লিপিবদ্ধ রাখা ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজন।
৮.
এখানে আরও একটি গুরুতর প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রশ্নটি সঠিক কিংবা বেঠিক আজও তা আমি জানি না। তবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, যখন এ পর্যন্ত কোনো ইতিহাস, তথ্য বা লেখনীতে এমন কারও নাম পাওয়া যায়নি, যারা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক অথবা সেক্টর কমান্ডার কিংবা সাব-সেক্টর কমান্ডার; তাদের নামে পাকিস্তান সামরিক জান্তা কোনো মামলা করেছিল কি না? করে থাকলে তা প্রকাশ করলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব। সামরিক অধিনায়কদের বাড়িতে কোনোদিন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কোনো লোক হানা দিয়েছিল কি না কিংবা তার বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল কি না জনমনে এই প্রশ্নটি রয়ে গেছে। অথচ প্রায় প্রতিটি জনপ্রতিনিধির বাড়িঘর দগ্ধ হয়েছে। আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে কিংবা রাজাকার-আলবদরদের অত্যাচারে গ্রামছাড়া করা হয়েছে। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধকে সামরিক যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, বিশেষ দিবস পালন করেন, পদক বা খেতাবে ভূষিত হয়ে আলোকোজ্জ্বল পাদপ্রদীপের সামনে গর্বোদ্ধত মস্তকে অভ্রভেদী হয়ে উঠেছেন তাদের কাছে আমার এ বিনীত প্রশ্ন থেকেই যাবে। তাদের দায়িত্ব বিষয়টি পরিষ্কার করা।
৯.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কর্মরত কতজন সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী অংশ নিয়েছিলেন এর পূর্ণাঙ্গ হিসাব থাকলে আজকে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে মিথ্যাচার করার সুযোগ থাকত না। যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভুয়া সনদ নিয়েছেন তারা শুধু নিজেদের অপমান করেননি, গোটা মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করেছেন। ব্যক্তির স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের সনদকে ব্যবহার করেছেন, এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে?
১০.
প্রায়শই বলা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘বাজেভাবে’ সময় কাটিয়েছে। তারা আরাম-আয়েশ করেছে। হোটেলে ফুর্তি করেছে। রণাঙ্গনে যায়নি। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। এসব অভিযোগ সর্বাংশে সঠিক নয়। তাদের জবাবে যুব-অভ্যর্থনা বা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলো কারা পরিচালনা করেছে এর একটি তালিকা ইতিহাসের পাতায় লিখিত আছে। বিজন জঙ্গলে, খোলা মাঠে বা সুবিধাবঞ্চিত কোনো স্থানে ক্যাম্পগুলো স্থাপিত হয়েছিল, যা প্রায়শই ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টার্গেটের আওতায়। সেসব স্থানে বসেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধে আগত হাজার হাজার ছেলের সঙ্গে একত্রে অবস্থান করেছে। ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই ক্যাম্পগুলোই ছিল ভিত্তিমূল। ১৯৭০ সালের নির্বাচিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ (এমএনএ) এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের (এমপিএ) সদস্যগণের অধিকাংশ সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনেকেই শর্ট সামরিক ট্রেনিং নেন। চরম দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝেও এই সকল রাজনৈতিক নেতৃত্ব অতুলনীয় দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে ভারত সীমান্তের দুর্গম ও জনমানব বসতিযোগ্য নয়, এমন স্থানে পরিচালনা করেছিলেন যুব ক্যাম্প ও ট্রেনিং ক্যাম্প।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এ সকল জনপ্রতিনিধির হূদয়কন্দরে অহর্নিশ দেদীপ্যমান চেতনায় বেগবান শক্তির উেস ছিলেন একটি নাম-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব; বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের পিতা। এমন এক বিস্ময় যে, হাজার মাইল দূরে লৌহ কারাগারে মৃত্যুর মুখোমুখি একজন মানুষ অথচ মুক্তিযুদ্ধে তিনিই ছিলেন আমাদের নিরন্তর জপমালা: শত্রু হননে অযুত প্রেরণার অন্তহীন আদর্শিক নির্দেশক।
লেখক : ’৭২ খসড়া সংবিধান প্রণেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
|